বহুদিন আগে ইতালির এক রাজা ছিল। শখ করে সে পৃথিবীর সব বিরল জিনিস সংগ্রহ করে সাজিয়ে রেখেছিল দুর্গে। একদিন এক লোক এসে রাজার ওই বিরল সংগ্রহশালার জিনিসগুলো দেখতে চাইল। রাজার অনুমতি নিয়ে সবকিছু খুব মনোযোগ দিয়ে দেখার পর বলল, “সবচেয়ে সেরা জিনিসটি এখানে নেই।”
“নেই মানে? কী সেই জিনিস?” রাজা জানতে চাইল।
“কথা বলে যে গাছ”, লোকটি বলল।
আসলেই তাই। রাজার এত জিনিসের মধ্যে কথা বলতে পারে এমন গাছ ছিল না। এরপর থেকে রাজার মনে আর শান্তি নেই। রাতে ঘুমাতে পারে না। সারা পৃথিবীতে সে লোক পাঠায় সে গাছ খুঁজতে। কিন্তু সবাই খালি হাতে ফিরে এল।
রাজা তখন ভাবল, লোকটি তার সঙ্গে মজা করেছে। তাই লোকটিকে ধরে আনার নির্দেশ দিল।
ধরে আনার পর লোকটি রাজাকে বলল, “আপনার লোকজন ঠিকমতো না খুঁজলে কীভাবে পাবে? ভালো করে খুঁজতে বলুন।”
“কিন্তু তুমি কি কথাবলা গাছ কখনও নিজের চোখে দেখেছ?”
“আমি নিজের চোখে ওই গাছ দেখেছি। নিজের কানে শুনেছিও বটে।”
“কোথায়?”
“এখন ঠিক মনে করতে পারছি না।”
“গাছটি কী বলেছিল মনে আছে?”
“হ্যাঁ, তা মনে আছে। গাছটি বলেছিল: যা কোনোদিন পাওয়া যাবে না তার জন্য অপেক্ষা সবচেয়ে বেশি কষ্টের।”
কথাটা তো আসলেই সত্যি। তাই রাজা আবার লোক পাঠাল সেই গাছের খোঁজে। সারা বছর খুঁজে আবারও তারা খালি হাতে ফিরে এল। এবার রাজা রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। আদেশ দিল যেন লোকটির মাথা কেটে ফেলে।
আবারও ধরে আনার পর লোকটি বলল, “কিন্তু আপনার লোকজন ঠিকমতো না খুঁজলে আমার অপরাধ কী? তাদের আরও ভালো করে খুঁজতে বলুন।”
এবার রাজাকে বিষয়টি সত্যিই ভাবিয়ে তুলল! রাজা সব মন্ত্রীকে ডেকে জানাল, সে নিজেই যাবে কথাবলা গাছটি খুঁজতে। গাছটিকে সংগ্রহশালায় না আনা পর্যন্ত সে নিজেকে যোগ্য রাজা ভাবতে পারছে না।
ছদ্মবেশ নিয়ে রাজা বের হয়ে পড়ল। হাঁটছে তো হাঁটছে। অনেকদিন পথ চলার পর এক রাতে একটি গভীর উপত্যকায় রাজা তাঁবু ফেলল। সেখানে কোনো প্রাণীর চিহ্ন নেই। ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ল রাজা। চোখ লেগে এলে হঠাৎ শুনতে পেল কে যেন কান্না করছে আর বলছে, “যা কোনোদিন পাওয়া যাবে না তার জন্য অপেক্ষা করা সবচেয়ে বেশি কষ্টের।”
রাজা জেগে গেল। কান খাড়া করল। আবারও শুনল কথাটা। সে স্বপ্ন দেখছে না তো!
না, জেগেই আছে। সত্যি শুনেছে। স্বপ্ন দেখছে না।
সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
কেউ উত্তর দিল না রাজার প্রশ্নের। কিন্তু পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাজা দেখল, তার পাশে একটি সুন্দর গাছ, যার ডালগুলো নুয়ে পড়েছে মাটিতে। রাজা ভাবল, এটিই সেই গাছ যা সে খুঁজছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে রাজা গাছটির দুটি পাতা ছিঁড়ে নিল।
“আহা! তুমি কেন আমাকে ছিঁড়ছ?”
একটি করুণ কণ্ঠ শুনতে পেল রাজা। মনে হল যেন খুব কষ্ট করে কথাগুলো বলছে কেউ। রাজা খুব সাহসী লোক। তারপরও হঠাৎ কথাটা শুনে ভয় পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
“আমি স্পেনের রাজকন্যা।”
“তুমি এখানে কী করে এলে?”
“একটি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানির ঝরনা দেখতে পেয়ে আমার খুব স্নান করতে ইচ্ছে হল। কী টলটলে পানি ঝরনার! দেখে মনটা স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে। স্নান করার লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু ঝরনার পানি গায়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এ অবস্থা হয়ে গেল।”
“আমি কীভাবে তোমাকে মুক্ত করতে পারি?”
“তোমাকে মন্ত্র খুঁজে বের করতে হবে। তারপর আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রæতি দিতে হবে।”
“ঠিক আছে। কিন্তু এখন বলো, কাল রাতে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি কেন?”
“এই চুপ, চুপ! ডাইনি আসছে! শব্দ করবে না! এখন এখান থেকে চলে যাও! আমি শুনতে পাচ্ছি সে আসছে। সে যদি তোমায় দেখে ফেলে, তাহলে তোমাকেও মন্ত্র দিয়ে এমন গাছ বানিয়ে দেবে।”
রাজা দেরি না করে পাশের একটি দেয়ালের আড়ালে চলে গেল। আড়াল থেকে দেখল, একটি ঝাড়ুর হাতলে চড়ে আসছে ডাইনি।
ডাইনি এসেই জিজ্ঞেস করল, “তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে?”
“বয়ে যাওয়া বাতাসের সঙ্গে।”
“কিন্তু আমি তো এখানে পায়ের ছাপ দেখছি।”
“ওগুলো তোমার হতে পারে।”
“এগুলো আমার? আমাকে তা বিশ্বাস করতে হবে?”
এই বলে ডাইনি গাছটিকে একটি লোহার মুগুর দিয়ে মারতে শুরু করল। আর সমানে চিৎকার করতে শুরু করল। বলল, “দাঁড়াও তোমাকে হাতে পেয়ে নিই! তারপর মজা দেখাব!”
গাছটি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি আর কখনও এমনটি করব না। কখনও না!”
কিন্তু ডাইনি চিৎকার করেই যাচ্ছে। “এগুলো আমার পায়ের ছাপ! অ্যাঁ, আমার পায়ের ছাপ! তোমাকে হাতে পাই একবার। তারপর দেখাব মজা!”
আড়াল থেকে এসব দেখে রাজার খুব মন খারাপ হল।
কিন্তু দেখা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তাই সে ভাবল, এখানে থেকে আর কাজ নেই। সে ঠিক করল, মন্ত্রটি খুঁজে বের করবে।
সে যে পথে এখানে এসেছিল, সে পথেই ফিরে চলল। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে সে পথ ভুল করে ফেলল। এক পরত ঘন কালো কুয়াশা রাজাকে আলতোভাবে ঘিরে রাখল।
কিছুদূর গিয়ে রাজা বুঝতে পারল, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে অনেক সময় পেরিয়ে গেল। শেষে রাতটা কাটানোর জন্য একটি উঁচু গাছে উঠে বসল। বুনো পশু থেকে নিরাপদে থাকার এটাই সবচেয়ে ভাল উপায়।
কিন্তু বন্য পশু না থাকলে কী হবে, সেখানেও শান্তি নেই। গভীর রাতে তীব্র চিৎকারে কেঁপে উঠল রাজার অন্তরাত্মা। শুধু রাজা নয়, পুরো বনটাই কাঁপছে থরথর করে। ওটা ছিল রাক্ষসের চিৎকার। রাক্ষস ফিরে আসছে। সঙ্গে রয়েছে শত শত কুকুর। কুকুরগুলো চিৎকার করছে।
রাক্ষস চিৎকার করে বলছে, “বাহ, কী চমৎকার সাদা মাংসের গন্ধ পাচ্ছি।” বলতে বলতে সেই গাছটার নিচে এসে থামল, যেটাতে রাজা বসে আছে। আবার শ্বাস টেনে বলল, “আহ, কী চমৎকার গন্ধ!”
ভয়ে রাজার শরীর হিম হয়ে এলো। চারদিকে অন্ধকার। ঘোর অন্ধকার। এক হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাই রাক্ষস আশপাশে একটু দেখে নিয়ে আবার চলে গেল। সঙ্গে ভয়ঙ্কর কুকুরগুলোও।
রাত পোহানোর পর রাজা ভয়ে ভয়ে গাছ থেকে নেমে এলো। সাবধানে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। কিছুদূর গিয়ে এক সুন্দর মেয়ের দেখা পেল।
রাজা মেয়েটিকে বলল, “হ্যাঁ গো মিষ্টি মেয়ে, তুমি কি আমায় এই বন থেকে বের হওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দেবে? আমি এক পথিক। পথ হারিয়েছি।”
“হা ঈশ্বর! তুমি কেন এই বনে এলে! আমার বাবা এখনই এপথ দিয়ে যাবে। এবং নিশ্চিত তোমাকে জীবন্ত গিলে খাবে!”
মেয়েটির কথা শেষ হতে না হতেই রাক্ষসের সেই ভয়ঙ্কর কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। রাক্ষসের গলাও শোনা গেল। একেবারে কাছে চলে এসেছে। রাজা ভাবল, “এবার বুঝি মরে গেলাম!”
মেয়েটি আতঙ্কিত স্বরে বলল, “তাড়াতাড়ি এখানে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়। আমি স্কার্ট দিয়ে তোমায় ঢেকে রাখব। একেবারে স্থির হয়ে থাকবে। পারলে শ্বাস-প্রশ্বাসও বন্ধ রাখবে!”
রাক্ষস এসে মেয়েকে বলল, “তুমি এখানে বসে আছ কেন?”
“বিশ্রাম নিচ্ছি।”
“ওহ তাই? কী চমৎকার একটি গন্ধ পাচ্ছি মাংসের!”
“এপথে একটি ছোট ছেলে যাচ্ছিল। আমি তাকে খেয়ে ফেলেছি।”
“ভালো করেছ। কিন্তু হাড়গোড়গুলো কোথায়?”
“ওগুলো কুকুরকে খাইয়ে দিয়েছি।”
তারপরও রাক্ষস বাতাসে শ্বাস টেনে গন্ধটা যেন পরীক্ষা করছে। “আহ, কী সুন্দর গন্ধ! একটু খেতে পেলে ভালই হত।”
“বাবা তুমি না বনের বাইরে সমুদ্র তীরে যাবে? এক্ষুণি যাও না। দেরি করে লাভ কী?”
রাক্ষস চলে গেলে রাজা মেয়েটিকে তার সব ঘটনা খুলে বলল। মেয়েটি রাজাকে বলল, “তুমি আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিলে, আমি তোমাকে সেই ধাঁধার মন্ত্র শিখিয়ে দিতে পারি।”
রাজা ভাবল, মেয়েটি সত্যিই খুব সুন্দরী। এই মেয়েকে বিয়ে করলে ভালোই হয়। কিন্তু রাজার আরেকজনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে গেল।
“হায় মিষ্টি মেয়ে, আমি যে আরেকজনকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছি!”
“সে আমার দুর্ভাগ্য। যাক, তাতে কোনো সমস্যা নেই।”
এই বলে মেয়েটি রাজাকে একটি বড় ভবনের কাছে নিয়ে গেল। এরপর মেয়েটি তার বাবার একটি মলমের কৌটা নিয়ে, তা থেকে একটুখানি রাজার গায়ে মেখে দিল। মুহুর্তের মধ্যে রাজার ওপর মোহ বিস্তার করল। তার মধ্যে অলৌকিক শক্তি এসে গেল।
রাজা বলে উঠল, “মেয়ে তুমি আমায় একটি কুঠার দেবে দয়া করে?”
“এই নাও।”
“কুঠারের ধারে এই তৈলাক্ত জিনিস কী?”
“এটা এক ধরনের তেল, যা কুঠারটি ধারালো রাখে।”
এই জাদুর সাহায্যে রাজা এখন এক মুহ‚র্তের মধ্যে সেই কথাবলা গাছের কাছে চলে গেল। সেখানে ডাইনি ছিল না। তাই গাছটি রাজাকে বলল, “সাবধান! আমার আত্মা এই গাছের কাণ্ডের ভেতর লুকান রয়েছে। ডাইনির সামনে তুমি আমাকে কাটতে থাকবে। কিন্তু ডাইনি যেভাবে বলে, সেভাবে তুমি আমায় কাটবে না। সে যদি উপরে আঘাত করতে বলে, তুমি করবে নিচে। আর যদি নিচে করতে বলে, তাহলে করবে উপরে। আর তা না করলে আমাকে হারাবে। আর সুযোগ বুঝে, ওই ডাইনির মাথা ঘাড় থেকে এক কোপে ফেলে দিতে হবে। না হলে সে তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে। তখন এই জাদুও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।”
কিছুক্ষণ পর ডাইনি ফিরে এল। রাজাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কী চাও?”
“কয়লা বানানোর জন্য আমি একটি গাছ চাই। এই গাছটা আমার পছন্দ হয়েছে। এই গাছটাই আমি চাই।”
ডাইনি বলল, “এটাতে তোমার চলবে? আচ্ছা, আমি তোমাকে এটি উপহার হিসেবে দেব। তবে একটি শর্ত আছে। আমি যেখানে বলব, তোমাকে গাছটির ঠিক সেখানেই কোপ দিতে হবে।”
“খুব ভালো কথা। এ আর এমন কী শক্ত!”
“এখানে কোপ দাও।” ডাইনি বলল।
কিন্তু রাজা আরেক স্থানে কোপ দিল। “ওহ, আমি ভুল করেছি! আমাকে আরেকটি সুযোগ দাও।”
রাজা তক্কে তক্কে আছে ডাইনির ঘাড়ে কোপ দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই সুযোগ পাচ্ছে না।
অবশেষে রাজা চিৎকার করে উঠল, “ও-ও-ও-হো!”
“কী দেখছ তুমি?” ডাইনি জিজ্ঞেস করল।
“একটি চমৎকার তারা!”
“এই দিনের বেলা তারা? অসম্ভব!” ডাইনির চোখে অবিশ্বাস।
“তুমি দেখ না, ওই! ওই যে ডালটার ওপর দিয়ে দেখ!”
যেই না ডাইনি ঘাড় ফিরিয়ে ডালের ওপর দেখতে চাইল, রাজা এক কোপে ডাইনির মাথা কেটে ফেলল।
ডাইনির মাথা কাটার পরপরই গাছটি থেকে একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে বের হয়ে এল। এত সুন্দর যে তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রাজা মেয়েটিকে বাঁচাতে পেরে খুব খুশি হল। তারপর তাকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এল। তার দুর্গে রাখল তাকে। রাজার নির্দেশে তাদের জমকালো বিয়ের আয়োজন হল।
বিয়ের দিন মেয়েরা যখন কাপড় পরাতে এল, তারা দেখল রানি খুব সুন্দর হলেও তার শরীর কিন্তু তৈরি হয়েছে কাঠের। একজন ছুটে গেল রাজার কাছে।
“মাননীয় রাজা, রানির শরীর রক্ত-মাংসের নয়, কাঠের।”
রাজা ও তার মন্ত্রীরা বিস্ময়কর ব্যাপারটি দেখতে গেল। দেখতে রানি একেবারে মানুষের মতো। যে কেউ দেখলে ভুল করবে। কিন্তু স্পর্শ করলে বুঝবে, তার শরীর কাঠে গড়া। এমনকি সে কথা বলতে পারে এবং চলাফেরাও করতে পারে। মন্ত্রীরা ঘোষণা করল, রাজা একটি কাঠের পুতুলকে বিয়ে করতে পারবে না। যতই সে কথা বলতে পারুক আর চলাচল করতে পারুক। তারা বিয়ের খাওয়া-দাওয়া এবং আনন্দ-উৎসব বাতিল করল। রাজা ভাবল, “এখনও নিশ্চয়ই ওই মেয়েটির উপর ডাইনির কোনো মন্ত্র রয়ে গেছে!”
এই ভেবে রাজা সেই গ্রিজমাখা কুঠারটির কথা স্মরণ করল। এরপর এক টুকরা মাংস নিয়ে কুঠার দিয়ে কাটল। সে ঠিকই আন্দাজ করেছিল। মাংসটি দেখতে একেবারে মাংসের মতো হলেও, স্পর্শ করলে বোঝা যায় সেটি আসলে কাঠ। রাক্ষসের মেয়ে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, ভাবল রাজা।
রাজা মন্ত্রীদের বলল, “আমি চলে যাচ্ছি, তবে শিগগিরই ফিরব।”
হাঁটতে হাঁটতে রাজা সেখানে চলে এল, যেখানে রাক্ষসের সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
“আবার এখানে? কোনো শুভ বাতাস তোমাকে এখানে নিয়ে এলো?” মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রাজার।
“প্রিয়া, আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছি।”
কিন্তু রাক্ষসের মেয়ে তার কথা বিশ্বাস করল না। “ওহ, তাই? রাজা, তুমি কি সত্যি আমার জন্য এসেছ?”
“আমি রাজা হয়ে তোমাকে বলছি।”
রাজা আসলে ঠিকই বলেছে। কিন্তু মেয়েটি ভাবল রাজা তাকে বিয়ে করতে এসেছে। তাই সে রাজাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
রাজা বলল, “এই নাও তোমার দেওয়া কুঠার।”
এই বলে রাজা কুঠার মেয়েটিকে দিল। দেওয়ার সময় রাজা মেয়েটির গায়ে কুঠার দিয়ে আলতো করে চাপ দিয়ে দিল। কেটে গেল একটু।
“আহ, কী করলে তুমি? আমি যে কাঠে পরিণত হয়ে যাচ্ছি!”
রাজা এমন ভান করল, যেন সে ভুল করে মারাত্মক কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে।
খুব উদ্বিগ্ন হওয়ার ভান করে রাজা বলল, “এটার কি কোনো প্রতিকার নেই?”
“হ্যাঁ, আছে। ওই আলমারিটা খোল। উপরের তাকে একটি কৌটায় মলম পাবে। ওই মলম আমার সারা শরীরে মেখে দাও। আমি তা হলে মুহ‚র্তেই সেরে যাব।”
মেয়েটির কথামতো রাজা মলমের কৌটাটি নিল। এরপর রাজা বলল, “আমি না আসা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা কর।” এই বলে সে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গেল।
মেয়েটি এবার ব্যাপারটা বুঝল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তখন সে চিৎকার করে বেঈমান প্রতারক ইত্যাদি বলতে বলতে রাজার পেছনে ছুটতে শুরু করল।
যখন দেখল, সে সুবিধা করতে পারছে না, মেয়েটি তার বাবার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নেকড়েটির শিকল খুলে দিল। নেকড়েটিকে বলল, রাজাকে ধাওয়া করতে।
কিন্তু কোনো কিছুই আর কাজে এলো না। রাজা এরই মধ্যে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে।
মলমের গুণে রানি সম্পূর্ণ জাদুমুক্ত হলো। আর তারপর মহা ধুমধামে রাজার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল।
“নেই মানে? কী সেই জিনিস?” রাজা জানতে চাইল।
“কথা বলে যে গাছ”, লোকটি বলল।
আসলেই তাই। রাজার এত জিনিসের মধ্যে কথা বলতে পারে এমন গাছ ছিল না। এরপর থেকে রাজার মনে আর শান্তি নেই। রাতে ঘুমাতে পারে না। সারা পৃথিবীতে সে লোক পাঠায় সে গাছ খুঁজতে। কিন্তু সবাই খালি হাতে ফিরে এল।
রাজা তখন ভাবল, লোকটি তার সঙ্গে মজা করেছে। তাই লোকটিকে ধরে আনার নির্দেশ দিল।
ধরে আনার পর লোকটি রাজাকে বলল, “আপনার লোকজন ঠিকমতো না খুঁজলে কীভাবে পাবে? ভালো করে খুঁজতে বলুন।”
“কিন্তু তুমি কি কথাবলা গাছ কখনও নিজের চোখে দেখেছ?”
“আমি নিজের চোখে ওই গাছ দেখেছি। নিজের কানে শুনেছিও বটে।”
“কোথায়?”
“এখন ঠিক মনে করতে পারছি না।”
“গাছটি কী বলেছিল মনে আছে?”
“হ্যাঁ, তা মনে আছে। গাছটি বলেছিল: যা কোনোদিন পাওয়া যাবে না তার জন্য অপেক্ষা সবচেয়ে বেশি কষ্টের।”
কথাটা তো আসলেই সত্যি। তাই রাজা আবার লোক পাঠাল সেই গাছের খোঁজে। সারা বছর খুঁজে আবারও তারা খালি হাতে ফিরে এল। এবার রাজা রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। আদেশ দিল যেন লোকটির মাথা কেটে ফেলে।
আবারও ধরে আনার পর লোকটি বলল, “কিন্তু আপনার লোকজন ঠিকমতো না খুঁজলে আমার অপরাধ কী? তাদের আরও ভালো করে খুঁজতে বলুন।”
এবার রাজাকে বিষয়টি সত্যিই ভাবিয়ে তুলল! রাজা সব মন্ত্রীকে ডেকে জানাল, সে নিজেই যাবে কথাবলা গাছটি খুঁজতে। গাছটিকে সংগ্রহশালায় না আনা পর্যন্ত সে নিজেকে যোগ্য রাজা ভাবতে পারছে না।
ছদ্মবেশ নিয়ে রাজা বের হয়ে পড়ল। হাঁটছে তো হাঁটছে। অনেকদিন পথ চলার পর এক রাতে একটি গভীর উপত্যকায় রাজা তাঁবু ফেলল। সেখানে কোনো প্রাণীর চিহ্ন নেই। ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ল রাজা। চোখ লেগে এলে হঠাৎ শুনতে পেল কে যেন কান্না করছে আর বলছে, “যা কোনোদিন পাওয়া যাবে না তার জন্য অপেক্ষা করা সবচেয়ে বেশি কষ্টের।”
রাজা জেগে গেল। কান খাড়া করল। আবারও শুনল কথাটা। সে স্বপ্ন দেখছে না তো!
না, জেগেই আছে। সত্যি শুনেছে। স্বপ্ন দেখছে না।
সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
কেউ উত্তর দিল না রাজার প্রশ্নের। কিন্তু পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাজা দেখল, তার পাশে একটি সুন্দর গাছ, যার ডালগুলো নুয়ে পড়েছে মাটিতে। রাজা ভাবল, এটিই সেই গাছ যা সে খুঁজছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে রাজা গাছটির দুটি পাতা ছিঁড়ে নিল।
“আহা! তুমি কেন আমাকে ছিঁড়ছ?”
একটি করুণ কণ্ঠ শুনতে পেল রাজা। মনে হল যেন খুব কষ্ট করে কথাগুলো বলছে কেউ। রাজা খুব সাহসী লোক। তারপরও হঠাৎ কথাটা শুনে ভয় পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
“আমি স্পেনের রাজকন্যা।”
“তুমি এখানে কী করে এলে?”
“একটি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানির ঝরনা দেখতে পেয়ে আমার খুব স্নান করতে ইচ্ছে হল। কী টলটলে পানি ঝরনার! দেখে মনটা স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে। স্নান করার লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু ঝরনার পানি গায়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এ অবস্থা হয়ে গেল।”
“আমি কীভাবে তোমাকে মুক্ত করতে পারি?”
“তোমাকে মন্ত্র খুঁজে বের করতে হবে। তারপর আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রæতি দিতে হবে।”
“ঠিক আছে। কিন্তু এখন বলো, কাল রাতে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি কেন?”
“এই চুপ, চুপ! ডাইনি আসছে! শব্দ করবে না! এখন এখান থেকে চলে যাও! আমি শুনতে পাচ্ছি সে আসছে। সে যদি তোমায় দেখে ফেলে, তাহলে তোমাকেও মন্ত্র দিয়ে এমন গাছ বানিয়ে দেবে।”
রাজা দেরি না করে পাশের একটি দেয়ালের আড়ালে চলে গেল। আড়াল থেকে দেখল, একটি ঝাড়ুর হাতলে চড়ে আসছে ডাইনি।
ডাইনি এসেই জিজ্ঞেস করল, “তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে?”
“বয়ে যাওয়া বাতাসের সঙ্গে।”
“কিন্তু আমি তো এখানে পায়ের ছাপ দেখছি।”
“ওগুলো তোমার হতে পারে।”
“এগুলো আমার? আমাকে তা বিশ্বাস করতে হবে?”
এই বলে ডাইনি গাছটিকে একটি লোহার মুগুর দিয়ে মারতে শুরু করল। আর সমানে চিৎকার করতে শুরু করল। বলল, “দাঁড়াও তোমাকে হাতে পেয়ে নিই! তারপর মজা দেখাব!”
গাছটি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি আর কখনও এমনটি করব না। কখনও না!”
কিন্তু ডাইনি চিৎকার করেই যাচ্ছে। “এগুলো আমার পায়ের ছাপ! অ্যাঁ, আমার পায়ের ছাপ! তোমাকে হাতে পাই একবার। তারপর দেখাব মজা!”
আড়াল থেকে এসব দেখে রাজার খুব মন খারাপ হল।
কিন্তু দেখা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তাই সে ভাবল, এখানে থেকে আর কাজ নেই। সে ঠিক করল, মন্ত্রটি খুঁজে বের করবে।
সে যে পথে এখানে এসেছিল, সে পথেই ফিরে চলল। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে সে পথ ভুল করে ফেলল। এক পরত ঘন কালো কুয়াশা রাজাকে আলতোভাবে ঘিরে রাখল।
কিছুদূর গিয়ে রাজা বুঝতে পারল, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে অনেক সময় পেরিয়ে গেল। শেষে রাতটা কাটানোর জন্য একটি উঁচু গাছে উঠে বসল। বুনো পশু থেকে নিরাপদে থাকার এটাই সবচেয়ে ভাল উপায়।
কিন্তু বন্য পশু না থাকলে কী হবে, সেখানেও শান্তি নেই। গভীর রাতে তীব্র চিৎকারে কেঁপে উঠল রাজার অন্তরাত্মা। শুধু রাজা নয়, পুরো বনটাই কাঁপছে থরথর করে। ওটা ছিল রাক্ষসের চিৎকার। রাক্ষস ফিরে আসছে। সঙ্গে রয়েছে শত শত কুকুর। কুকুরগুলো চিৎকার করছে।
রাক্ষস চিৎকার করে বলছে, “বাহ, কী চমৎকার সাদা মাংসের গন্ধ পাচ্ছি।” বলতে বলতে সেই গাছটার নিচে এসে থামল, যেটাতে রাজা বসে আছে। আবার শ্বাস টেনে বলল, “আহ, কী চমৎকার গন্ধ!”
ভয়ে রাজার শরীর হিম হয়ে এলো। চারদিকে অন্ধকার। ঘোর অন্ধকার। এক হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাই রাক্ষস আশপাশে একটু দেখে নিয়ে আবার চলে গেল। সঙ্গে ভয়ঙ্কর কুকুরগুলোও।
রাত পোহানোর পর রাজা ভয়ে ভয়ে গাছ থেকে নেমে এলো। সাবধানে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। কিছুদূর গিয়ে এক সুন্দর মেয়ের দেখা পেল।
রাজা মেয়েটিকে বলল, “হ্যাঁ গো মিষ্টি মেয়ে, তুমি কি আমায় এই বন থেকে বের হওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দেবে? আমি এক পথিক। পথ হারিয়েছি।”
“হা ঈশ্বর! তুমি কেন এই বনে এলে! আমার বাবা এখনই এপথ দিয়ে যাবে। এবং নিশ্চিত তোমাকে জীবন্ত গিলে খাবে!”
মেয়েটির কথা শেষ হতে না হতেই রাক্ষসের সেই ভয়ঙ্কর কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। রাক্ষসের গলাও শোনা গেল। একেবারে কাছে চলে এসেছে। রাজা ভাবল, “এবার বুঝি মরে গেলাম!”
মেয়েটি আতঙ্কিত স্বরে বলল, “তাড়াতাড়ি এখানে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়। আমি স্কার্ট দিয়ে তোমায় ঢেকে রাখব। একেবারে স্থির হয়ে থাকবে। পারলে শ্বাস-প্রশ্বাসও বন্ধ রাখবে!”
রাক্ষস এসে মেয়েকে বলল, “তুমি এখানে বসে আছ কেন?”
“বিশ্রাম নিচ্ছি।”
“ওহ তাই? কী চমৎকার একটি গন্ধ পাচ্ছি মাংসের!”
“এপথে একটি ছোট ছেলে যাচ্ছিল। আমি তাকে খেয়ে ফেলেছি।”
“ভালো করেছ। কিন্তু হাড়গোড়গুলো কোথায়?”
“ওগুলো কুকুরকে খাইয়ে দিয়েছি।”
তারপরও রাক্ষস বাতাসে শ্বাস টেনে গন্ধটা যেন পরীক্ষা করছে। “আহ, কী সুন্দর গন্ধ! একটু খেতে পেলে ভালই হত।”
“বাবা তুমি না বনের বাইরে সমুদ্র তীরে যাবে? এক্ষুণি যাও না। দেরি করে লাভ কী?”
রাক্ষস চলে গেলে রাজা মেয়েটিকে তার সব ঘটনা খুলে বলল। মেয়েটি রাজাকে বলল, “তুমি আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিলে, আমি তোমাকে সেই ধাঁধার মন্ত্র শিখিয়ে দিতে পারি।”
রাজা ভাবল, মেয়েটি সত্যিই খুব সুন্দরী। এই মেয়েকে বিয়ে করলে ভালোই হয়। কিন্তু রাজার আরেকজনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে গেল।
“হায় মিষ্টি মেয়ে, আমি যে আরেকজনকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছি!”
“সে আমার দুর্ভাগ্য। যাক, তাতে কোনো সমস্যা নেই।”
এই বলে মেয়েটি রাজাকে একটি বড় ভবনের কাছে নিয়ে গেল। এরপর মেয়েটি তার বাবার একটি মলমের কৌটা নিয়ে, তা থেকে একটুখানি রাজার গায়ে মেখে দিল। মুহুর্তের মধ্যে রাজার ওপর মোহ বিস্তার করল। তার মধ্যে অলৌকিক শক্তি এসে গেল।
রাজা বলে উঠল, “মেয়ে তুমি আমায় একটি কুঠার দেবে দয়া করে?”
“এই নাও।”
“কুঠারের ধারে এই তৈলাক্ত জিনিস কী?”
“এটা এক ধরনের তেল, যা কুঠারটি ধারালো রাখে।”
এই জাদুর সাহায্যে রাজা এখন এক মুহ‚র্তের মধ্যে সেই কথাবলা গাছের কাছে চলে গেল। সেখানে ডাইনি ছিল না। তাই গাছটি রাজাকে বলল, “সাবধান! আমার আত্মা এই গাছের কাণ্ডের ভেতর লুকান রয়েছে। ডাইনির সামনে তুমি আমাকে কাটতে থাকবে। কিন্তু ডাইনি যেভাবে বলে, সেভাবে তুমি আমায় কাটবে না। সে যদি উপরে আঘাত করতে বলে, তুমি করবে নিচে। আর যদি নিচে করতে বলে, তাহলে করবে উপরে। আর তা না করলে আমাকে হারাবে। আর সুযোগ বুঝে, ওই ডাইনির মাথা ঘাড় থেকে এক কোপে ফেলে দিতে হবে। না হলে সে তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে। তখন এই জাদুও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।”
কিছুক্ষণ পর ডাইনি ফিরে এল। রাজাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কী চাও?”
“কয়লা বানানোর জন্য আমি একটি গাছ চাই। এই গাছটা আমার পছন্দ হয়েছে। এই গাছটাই আমি চাই।”
ডাইনি বলল, “এটাতে তোমার চলবে? আচ্ছা, আমি তোমাকে এটি উপহার হিসেবে দেব। তবে একটি শর্ত আছে। আমি যেখানে বলব, তোমাকে গাছটির ঠিক সেখানেই কোপ দিতে হবে।”
“খুব ভালো কথা। এ আর এমন কী শক্ত!”
“এখানে কোপ দাও।” ডাইনি বলল।
কিন্তু রাজা আরেক স্থানে কোপ দিল। “ওহ, আমি ভুল করেছি! আমাকে আরেকটি সুযোগ দাও।”
রাজা তক্কে তক্কে আছে ডাইনির ঘাড়ে কোপ দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই সুযোগ পাচ্ছে না।
অবশেষে রাজা চিৎকার করে উঠল, “ও-ও-ও-হো!”
“কী দেখছ তুমি?” ডাইনি জিজ্ঞেস করল।
“একটি চমৎকার তারা!”
“এই দিনের বেলা তারা? অসম্ভব!” ডাইনির চোখে অবিশ্বাস।
“তুমি দেখ না, ওই! ওই যে ডালটার ওপর দিয়ে দেখ!”
যেই না ডাইনি ঘাড় ফিরিয়ে ডালের ওপর দেখতে চাইল, রাজা এক কোপে ডাইনির মাথা কেটে ফেলল।
ডাইনির মাথা কাটার পরপরই গাছটি থেকে একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে বের হয়ে এল। এত সুন্দর যে তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রাজা মেয়েটিকে বাঁচাতে পেরে খুব খুশি হল। তারপর তাকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এল। তার দুর্গে রাখল তাকে। রাজার নির্দেশে তাদের জমকালো বিয়ের আয়োজন হল।
বিয়ের দিন মেয়েরা যখন কাপড় পরাতে এল, তারা দেখল রানি খুব সুন্দর হলেও তার শরীর কিন্তু তৈরি হয়েছে কাঠের। একজন ছুটে গেল রাজার কাছে।
“মাননীয় রাজা, রানির শরীর রক্ত-মাংসের নয়, কাঠের।”
রাজা ও তার মন্ত্রীরা বিস্ময়কর ব্যাপারটি দেখতে গেল। দেখতে রানি একেবারে মানুষের মতো। যে কেউ দেখলে ভুল করবে। কিন্তু স্পর্শ করলে বুঝবে, তার শরীর কাঠে গড়া। এমনকি সে কথা বলতে পারে এবং চলাফেরাও করতে পারে। মন্ত্রীরা ঘোষণা করল, রাজা একটি কাঠের পুতুলকে বিয়ে করতে পারবে না। যতই সে কথা বলতে পারুক আর চলাচল করতে পারুক। তারা বিয়ের খাওয়া-দাওয়া এবং আনন্দ-উৎসব বাতিল করল। রাজা ভাবল, “এখনও নিশ্চয়ই ওই মেয়েটির উপর ডাইনির কোনো মন্ত্র রয়ে গেছে!”
এই ভেবে রাজা সেই গ্রিজমাখা কুঠারটির কথা স্মরণ করল। এরপর এক টুকরা মাংস নিয়ে কুঠার দিয়ে কাটল। সে ঠিকই আন্দাজ করেছিল। মাংসটি দেখতে একেবারে মাংসের মতো হলেও, স্পর্শ করলে বোঝা যায় সেটি আসলে কাঠ। রাক্ষসের মেয়ে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, ভাবল রাজা।
রাজা মন্ত্রীদের বলল, “আমি চলে যাচ্ছি, তবে শিগগিরই ফিরব।”
হাঁটতে হাঁটতে রাজা সেখানে চলে এল, যেখানে রাক্ষসের সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
“আবার এখানে? কোনো শুভ বাতাস তোমাকে এখানে নিয়ে এলো?” মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রাজার।
“প্রিয়া, আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছি।”
কিন্তু রাক্ষসের মেয়ে তার কথা বিশ্বাস করল না। “ওহ, তাই? রাজা, তুমি কি সত্যি আমার জন্য এসেছ?”
“আমি রাজা হয়ে তোমাকে বলছি।”
রাজা আসলে ঠিকই বলেছে। কিন্তু মেয়েটি ভাবল রাজা তাকে বিয়ে করতে এসেছে। তাই সে রাজাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
রাজা বলল, “এই নাও তোমার দেওয়া কুঠার।”
এই বলে রাজা কুঠার মেয়েটিকে দিল। দেওয়ার সময় রাজা মেয়েটির গায়ে কুঠার দিয়ে আলতো করে চাপ দিয়ে দিল। কেটে গেল একটু।
“আহ, কী করলে তুমি? আমি যে কাঠে পরিণত হয়ে যাচ্ছি!”
রাজা এমন ভান করল, যেন সে ভুল করে মারাত্মক কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে।
খুব উদ্বিগ্ন হওয়ার ভান করে রাজা বলল, “এটার কি কোনো প্রতিকার নেই?”
“হ্যাঁ, আছে। ওই আলমারিটা খোল। উপরের তাকে একটি কৌটায় মলম পাবে। ওই মলম আমার সারা শরীরে মেখে দাও। আমি তা হলে মুহ‚র্তেই সেরে যাব।”
মেয়েটির কথামতো রাজা মলমের কৌটাটি নিল। এরপর রাজা বলল, “আমি না আসা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা কর।” এই বলে সে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গেল।
মেয়েটি এবার ব্যাপারটা বুঝল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তখন সে চিৎকার করে বেঈমান প্রতারক ইত্যাদি বলতে বলতে রাজার পেছনে ছুটতে শুরু করল।
যখন দেখল, সে সুবিধা করতে পারছে না, মেয়েটি তার বাবার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নেকড়েটির শিকল খুলে দিল। নেকড়েটিকে বলল, রাজাকে ধাওয়া করতে।
কিন্তু কোনো কিছুই আর কাজে এলো না। রাজা এরই মধ্যে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে।
মলমের গুণে রানি সম্পূর্ণ জাদুমুক্ত হলো। আর তারপর মহা ধুমধামে রাজার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল।
Tags
গল্পের আসর