আমরা দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কতই না উদাসীন। প্রতিনিয়তই আমরা ভুলভাবে ব্যবহার করি এমন কিছু শব্দ ও বাক্য নিয়ে এখানে আলোচনা করা যেতে পারে। টেলিভিশনে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন বলা হতো—‘আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যত্।’ এখানে একই বাক্যে ভবিষ্যত্ শব্দের দ্বিত্ব ব্যবহার লক্ষণীয়। আগামী দিন মানেই তো ভবিষ্যত্ কাল বা সময়ের নির্দেশক। সেখানে আবার ভবিষ্যত্ বলার প্রয়োজন কী? বরং বাক্যটি এমনভাবে বলা যায়—‘আজকের শিশুই আগামী দিনের নাগরিক’ অথবা ‘আজকের শিশুই দেশের ভবিষ্যত্।’ বলা হয়, আগামী মাসে দেশে বন্যার সম্ভাবনা আছে। এখানে ‘সম্ভাবনা’ শব্দের বিভ্রান্তিকর ব্যবহার লক্ষণীয়। সম্ভাবনা শব্দটি সাধারণত ভালো বা শুভ কিছু বোঝানোর জন্য ব্যবহূত হয়। যেমন—এ বছর দেশে ধানের বাম্পার ফলন হবার সম্ভাবনা আছে। ভয় বা ভীতিকর কিছু বোঝানোর জন্য আশঙ্কা শব্দ প্রয়োগ করা হয়। কাজেই বন্যার আশঙ্কা আছে বলাই উত্তম। উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, নাকি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়? এখানে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় শব্দটিই সঠিক প্রয়োগ। কারণ শব্দটি দিয়ে বালিকার উচ্চতা বোঝানো হয়নি। বিদ্যালয়ের শ্রেণিবিন্যাস বোঝানো হয়েছে। নির্বাচনি পোস্টারে লেখা হয়, ‘আসন্ন ধামরাই উপজেলার নির্বাচনে...’। এখানে ধামরাই উপজেলা আসন্ন নয়, নির্বাচনটিই আসন্ন। তাই লেখা উচিত ধামরাই উপজেলার আসন্ন নির্বাচনে—এটাই সঠিক। পত্রিকায় প্রায়শই লেখা হয়, খেলাপি ঋণগ্রহীতা। আসলে এটা হবে ঋণখেলাপি। কারণ কেউ খেলাপি ঋণ গ্রহণ করে না ঋণ গ্রহণ করার পরই খেলাপি হয়। বলা হয়, চুরির দায়ে রহিম গ্রেপ্তার। কিন্তু এটি আসলে হবে চুরির অভিযোগে রহিম গ্রেপ্তার। কারণ কেউ আদালত কর্তৃক দোষী প্রমাণিত না হলে তাকে দায়ী বলা যায় না। প্রত্যেকটি অপরাধের আলাদা আলাদা সংজ্ঞা আছে। বিশেষ করে আইন বিষয়ক কোনো কিছু লিখতে বা বলতে গেলে এগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা দরকার। কোনটা চুরি, কোনটা ডাকাতি এবং কী করলে ছিনতাই বলে বিবেচিত হবে তা সবই আইনে উল্লেখ আছে।
শব্দ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সব সময়ই দায়িত্বশীল হতে হবে। ‘তবে’ এবং ‘তাহলে’ শব্দ দু’টি আমরা বেশিরভাগ সময় একই অর্থ বোঝানোর জন্য ব্যবহার করি, যা মোটেও ঠিক নয়। প্রায় সমার্থক দুটি বাক্যকে সংযুুক্ত করার ক্ষেত্রে তাহলে শব্দ ব্যবহূত হয়। অন্যদিকে কিন্তু শব্দের ঘনিষ্ঠ বিকল্প হিসেবে ‘তবে’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। যেমন—আমি কমলাপুর যাব তাহলে ট্রেনে উঠতে পারব। অন্যদিকে, আমি কমলাপুর যাব তবে ট্রেনে উঠব না। এই দুটি শব্দ কি একই অর্থবোধক? শর্ত সাপেক্ষে দুটি বাক্যকে সংযুক্ত করলে সে ক্ষেত্রে ‘তবে’ ব্যবহূত হয়। বিরাট গরু-ছাগলের হাট নয়,গরু-ছাগলের বিরাট হাট এবং একইভাবে খাঁটি গরুর দুধ নয়, গরুর খাঁটি দুধ বলাই উত্তম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলাদের নামের আগে ‘জনাবা’ লেখা হয়। অভিধানে জনাবা বলে কোনো শব্দ নেই। কারো কারো মতে, আরবি ভাষায় জনাবা বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ গর্ভবতী শূকর। নিশ্চয়ই একজন মহিলা জনাবা সম্বোধনে খুশি হবেন না। জনাব শব্দের কোনো লিঙ্গান্তর প্রয়োজন নেই। মহিলাদের নামের আগেও জনাব ব্যবহার করা যায়। অথবা মিসেস বা বেগম শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে।
কেউ কেউ প্রতিটি বিদেশি শব্দের বাংলা ভার্সন ব্যবহার করতে চান। এটাও ঠিক নয়। কোনো বিদেশি শব্দ যদি বাংলা ভাষায় গৃহীত এবং ব্যবহূত হয়ে থাকে তাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার কোনো কারণ নেই। ভাষা একটি বহমান বা চলমান প্রক্রিয়া। এর গতি রুদ্ধ করার চেষ্টা না করাই ভালো। আমরা জানি বাংলা ভাষায় প্রচুর বিদেশি শব্দ আছে যেগুলো এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ বলেই পরিগণিত হচ্ছে। আরবি, ফার্সি, সংস্কৃতি এমনকী ল্যাটিন ভাষা থেকেও অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। আমাদের বিদেশি ভাষা থেকে উদারভাবে বিভিন্ন শব্দ গ্রহণ করতে হবে। শুধু একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে—গৃহীত বিদেশি শব্দ যাতে আমাদের বাংলা ভাষার মাধুর্য নষ্ট না করে।
Tags
অন্যান্য