ছোট গল্প দুই ভাই

মুভাম্বা আর লুয়েম্বা ছিলো দুই যমজ ভাই, একদম একরকম দেখতে। একসাথে খেলাধূলা আর শিক্ষাদীক্ষা করে বড় হচ্ছিলো তারা। দুইজনে একরকম দেখতে হলে কী হয়, দুইজনের ভাগ্যচক্র ছিলো আলাদা। জন্মের পরে নামকরণের সময় তাদের ভাগ্যচক্র গণনা করেছিলো যে গুণিন, সে তাদের দুই ভাইয়ের গলায় পরিয়ে দিলো দুইরকম দুইখান লকেট, তার ভিতরে রইলো যার যার ভাগ্যচিহ্ন।

দিন যায়, রাত কাটে। দেখতে দেখতে মুভাম্বা আর লুয়েম্বা বড় হয়ে ওঠে। তারা দুইজনেই যখন পূর্ণ যুবক, তখন শোনা গেলো দূরের এক গ্রামের নেত্রী নিজাম্বির পরমাসুন্দরী কন্যা ইজা বিবাহযোগ্যা। একে একে চিতাবাঘ গোত্রের, হরিণ গোত্রের আর ঈগল গোত্রের যুবকেরা তার পাণিপ্রার্থী হয়ে এলো, কিন্তু ইজা সবিনয়ে তাদের সবাইকে প্রত্যাখ্যান করলো। কারুকে দেখে তার মনে হয় নি সে এরই স্ত্রী হবার জন্যে সৃষ্টি হয়েছিলো।

মুভাম্বা আর লুয়েম্বা এসব শুনলো জনরবে। মুভাম্বা নিজের ব্যাঘ্রচমের পোশাকটি পরে মাথার চুলে যত্নসহকারে ভুট্টাবেণী করে তীরধনুক নিয়ে চললো ইজার গ্রামের দিকে। সে নিজের ভাগ্যপরীক্ষা করতে চায়, দেখাই যাক না ইজা কী বলে।

গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে বিকাল বেলা মুভাম্বা গিয়ে পৌঁছলো ইজার গ্রামে। তাকে পথে দেখেই ইজা একেবারে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেললো, ভাবলো "এই তো সেই মানুষ, যে আমার স্বামী হলে পরম সুখের কথা হবে।"

ইজার মা জননেত্রী, তাঁর ক্ষমতা সেই গ্রামে যাকে বলে নিরঙ্কুশ। বিবাহের জন্য তাঁর অনুমতি দরকার।

ইজা গিয়ে তাঁকে বললো," মা, শোনো, আমি যাকে বিবাহ করতে চাই, আজ তার দেখা পেয়েছি। এখন তুমি যদি তার সঙ্গে আমার বিবাহ না দাও, তবে আমাকে আর দেখতে পাবে না, আমি মারা যাবো। এমনিতে না মরলে সামনের কুমীরজলা তো আছে, সেখানে ঝাঁপ দেবো।"

নিজাম্বি আপত্তি করে নি, মুভাম্বাকে তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছিলো।

বিবাহের বিরাট আয়োজন হলো, আনুষ্ঠানিক বিবাহকর্ম সম্পন্ন হলে ইজা আর মুভাম্বাকে একটা সুন্দর কুটিরে নিয়ে যাওয়া হলো, বাইরে তখন সারা গ্রামের লোক খানাপিনা আর নাচগান করছে বিবাহে নিমন্ত্রিত হয়ে এসে।

মুভাম্বা সেই কুটিরে ঢুকে দেখলো পরিপাটী সাজানো ঘর, ভারী চমৎকার বিছানা ও পাতা আছে। একটা জিনিস দেখে কিন্তু মুভাম্বা বেশ অবাক হলো, সে দেখলো ঘরের দেয়ালে পরপর আয়না ঝোলানো আছে, কিন্তু সব আয়না কাপড় দিয়ে ঢাকা।

বিস্মিত হয়ে সে ইজাকে জিজ্ঞাসা করলো, "ইজা, ঐ আয়নাগুলো ওরকম ঢাকা কেন?"

ইজা বললো, "ঢাকনা তুলে একেক আয়নার সামনে যদি দাঁড়াও, তবে দেখতে পাবে যে যে গ্রাম তুমি পার হয়ে এসেছ, সেই সেই গ্রামের দৃশ্য। দেখবে? "

ইজা হাত ধরে মুভাম্বাকে প্রথম আয়নার সামনে নিয়ে গেলো, ঢাকনা তুলে দিলো। মুভাম্বা অবাক হয়ে দেখলো, আরে তাই তো, আয়নার ভিতরে সেই প্রথম গ্রামটা, সবুজ গ্রাম, সকালের রোদে ঝলমল করছে গাছের সবুজ পাতাগুলো, চকচক করছে পুকুরের জল।

সেই আয়নার সামনে থেকে পরের আয়নার কাছে গিয়ে ঢাকনা তুলে ফেললো ইজা, মুভাম্বা আয়নার সামনে এসে দেখলো আরে এতো সেই পরের গ্রামটার দৃশ্য! সেই যে ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে গাছের ছায়ায় বসে বসে গুণ গুণ করে গান করছিলো এক উদাস লোক, সেই গ্রামেই তো! আশ্চর্য!

এইভাবে পরপর সব আয়না দেখা হয়ে গেলো, বাকী রইলো শুধু শেষ আয়নাটা। সেটা মুভাম্বা দেখতে চাইতেই ইজা ভয়ে ভয়ে বললো, "ওটা দেখতে চেয়ো না গো। ঐ আয়না তোমার চেনা কোনো গ্রাম দেখাবে না, ওটা সেই গ্রাম দেখায়, যেখান থেকে কেউ ফেরে না।"

মুভাম্বা কৌতূহলে ফেটে পড়ে ইজাকে সরিয়ে যেতে চায় আয়নার কাছে, ইজা কাঁদতে কাঁদতে আটকাতে চেষ্টা করে মুভাম্বাকে। কিন্তু পারে না, দুর্নিবার কৌতূহলে মুভাম্বা সেই আয়নার সামনে গিয়ে একটানে সরিয়ে দেয় ঢাকনা, আয়নার মধ্যে ফুটে ওঠে সেই রহস্যময় গ্রামের দৃশ্য, সারি সারি পাথরের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, সব কিছু কেমন ধোঁয়াটে, আবছা, বিষন্ন কিন্তু তীব্র আকর্ষক।

মুভাম্বা সব ভুলে গেলো, বিবাহ, ইজা, উৎসব---সব কিছু। যেই অবস্থাতে ছিলো সেই অবস্থাতে ছুটে বেরিয়ে গেল, সেই রহস্যময় গ্রামে তাকে যেতে হবে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকলো ইজা, মুভাম্বার কানে গেলো না কিছু।

সে চললো আর চললো, কেজানে কতদিন কতরাত। তারপরে সেই গ্রামে পৌঁছে সে দেখলো ঠিক আয়নায় দেখা মূর্তির মতন সব পাথরমূর্তি পথের দুইধারে, পাথর হয়ে যাওয়া মানুষ তারা।

মুভাম্বা আরো এগিয়ে গেলো, চৌরাস্তায় এসে দেখলো এক বুড়ী বসে আছে, বুড়ী তাকে দেখে কেমন অদ্ভুত ভাবে হাসলো, তারপরে খনখনে গলায় বললো, "বাছা, একটু আগুন দিতে পারিস?"

মুভাম্বা তার ঝোলা থেকে আগুনের পাতিল যেই না বার করতে যাবে, অমনি সেই বুড়ী এসে তার মাথায় মারলো যাদুলাঠির বাড়ি, ব্যস, মুভাম্বা অবশ হয়ে গেলো, তারপরে বুড়ী মুভাম্বার গলার হারটি খুলে লকেটটিতে কী যেন মন্তর পড়ে আবার পরিয়ে দিলো, আর মুভাম্বা পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে।

এদিকে কানাঘুষো্য় মুভাম্বার ইজার সাথে বিবাহ ও বিবাহরাত্রে মুভাম্বার নিরুদ্দেশ হবার খবর গিয়ে পৌঁছেছে তার নিজের গ্রামে। ভাই লুয়েম্বা ঠিক করলো সে নিজে যাবে ইজাদের গ্রামে, সেখানে গিয়ে সব শুনবে ঠিকমতন।

যা ভাবা সেই কাজ, লুয়েম্বা গেল সেখানে। তাকে দেখে তো ইজা খুশিতে ছুটে এসে তার হাত ধরে বললো, "তুমি ফিরে এসেছ! কেউ যেখান থেকে ফেরে না, সেখান থেকে তুমি ফিরেছ? আহা, আমার কী সৌভাগ্য!"

লুয়েম্বা বুঝেছে ইজা তাকে মুভাম্বা মনে করেছে, তারা দুই ভাই যে একরকম দেখতে যমজ।

সে সব বুঝিয়ে বললো ইজাকে, তারপরে জানতে চাইলো ঠিক কী হয়েছিলো মুভাম্বার। ইজা সব বললো। সব শুনে লুয়েম্বা রওনা হলো সেই মরণগ্রামের দিকে, ইজার আপত্তি সবিনয়ে খন্ডন করে।

সেই গ্রামে গিয়ে সে দেখলো সারি সারি মূর্তি, তারপরে সেই চৌমাথার মোড়ে সেই রহস্যময়ী যাদুকরী বুড়ী। সেই বুড়ী যেই না বলেছে, "একটু আগুন দিবি বাছা? " অমনি লুয়েম্বা বুড়ির মাথায় মেরেছে বাড়ি। বুড়ী মাটিতে পড়ে মরে গেছে, তার যাদুলাঠিটি হাত থেকে পড়ে গড়িয়ে গেছে।

লুয়েম্বা সেই যাদুলাঠি আর নিজের লকেটের ছো্ঁয়া দিয়ে মুভাম্বাকে প্রথম বাঁচিয়ে তুললো, তারপরে দুইজনে মিলে নিজের নিজের লকেট ছুঁইয়ে সেখানের সব পাথর হয়ে যাওয়া মানুষদের বাঁচিয়ে তুললো। এখন তারা দুই ভাই নিজের রাজ্য স্থাপন করতে পারে, শত শত নিবেদিতপ্রাণ যুবক প্রজা পেয়ে গেছে তারা।

সকলে মিলে যখন ইজাদের গ্রামে গেল, তখন সবাই দেখে আনন্দে নৃত্য করলো।

তারপরে সকলে সুখেশান্তিতে বাস করতে লাগলো।

Post a Comment

Previous Post Next Post