বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলা একটি ঐতিহাসিক স্থান। এর অবস্থান বরিশাল জেলার উত্তর সীমান্ত ঘেষে। মুলাদী উপজেলার উত্তর সীমান্তে জয়ন্তী নামে একটি নদী রয়েছে, সেই নদীটি পার হলেই উত্তর-পশ্চিম কোনে মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলা, সোজা উত্তর দিকে শরীয়তপুর জেলার ঘোষাইরহাট উপজেলা, পুর্ব সীমান্তে চাঁদপুর জেলা হাইমচর উপজেলা। মুলাদী উপজেলাটি বিভিন্নভাবে ঐতিহাসিক। এই উপজেলার চারপাশ দিয়ে বয়ে গেছে নয়া ভাংগনী ও ছৈলা নদী। মুলাদী উপজেলার মোট ইউনিয়নের সংখ্যা ৭টি। পৌরসভা রয়েছে ১টি। এখানে শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নেই রয়েছে ১টি কলেজ ও পর্যাপ্ত পরিমানে অন্যন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যাতায়াত-যোগাযোগঃ
যাতায়াতের দিক থেকে মুলাদী একটি সহজগম্য এলাকা। মুলাদী যেতে হলে ঢাকার সদরঘাট থেকে এমভি কাজল, এমডি মানিক, এমডি জলতরঙ্গ, এমডি নিউসান-৪, এমডি মনিং সান লঞ্চে মুলাদী বন্দরে পৌছা যায়। এছাড়াও ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী থেকে বরিশালের উদ্দেশ্য ছেড়ে যাওয়া বাসে রহমতপুর অর্থাৎ বরিশাল বিমানবন্দর ষ্টেশনে নেমে লোকাল বাস, টেম্পু অবা মোটর সাইকেলে মীরগঞ্জ ফেরি পার হয়ে মুলাদী সদরসহ প্রতিটি ইউনিয়নে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সরাসরি লঞ্চে বরিশাল শহরে নেমে নতুল্লাবাদ গিয়ে লোকাল বাসে মুলাদী যাওয়া যায়।
রাত্রি যাপনঃ
মুলাদী রাত্রি যাপন নিয়েও পর্যটকদের কোন চিন্তা করতে হবে না। মুলাদীতে উপজেলা সদরেই রয়েছে জেলা পরিষদের সুন্দর একটি ডাকবাংলা। এছাড়াও ব্যক্তি মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে এখানে। খুব অল্প ভাড়ায় এখানে থাকার সু-ব্যবস্থা রয়েছে। যারা সাংবাদিক, কবি, লেখক তারা মুলাদীতে বেড়াতে গেলে পূর্ব থেকে মুলাদী প্রেসক্লাব, মুলাদী রিপোর্টাস ইউনিটি, স্থানীয় আরজেএফ’র সাথে যোগাযোগ করে গেলে তাদের অতিথি হিসাবেই আপনারা মুলাদীর দর্শনীয় স্থানগুলো উপভোগ করতে পারবেন। মুলাদীতে কর্মরত বিভিন্ন গনমাধ্যমের কর্মীরা পর্যটকদের মোটর সাইকেল যোগে দর্শনীয় প্রতিটি স্থান ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করবে। এছাড়াও মুলাদী উপজেলা সদর থেকে বরিশাল শহর মাত্র ১ ঘন্টার পথ। আপনি ইচ্ছে করলে সারাদিন মুলাদীর ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে বরিশাল শহরে রাত্রী যাপন করতে পারবেন।
যা দেখবেন মুলাদীতেঃ...
মুলাদী সদরে যে বন্দরটি অবস্থিত তার নাম মুলাদী বন্দর, একটি বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যর এটি ঐতিহ্যবাহী বন্দর। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য সর্ববৃহৎ বন্দর হল মুলাদী বন্দর। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাঠের আড়ৎ এই বন্দরে।। আপনি সুলভমূল্যে এখানে থেকে যে কোন ধরনের কাঠ কিনতে পারবেন। মুলাদী বন্দরের চারপাশ ঘিরে নদী। আপনি ঘুরে দেখলে ভাল লাগবে। ভাড়া করা নৌকা, ট্রলার বা প্রীট বোটে আপনি এ সব নদী ঘুরতে পারেন। মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে গেলে আপনি স্ব-চুখে দেখতে পারবেন “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারী আমি কি ভুলিতে পারি” সহ হাজারো গানের সুরকার, গীতিকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের জন্মস্থান। সেখানে রয়েছে তার শিশুকাল, যৌবনের অনেক স্মৃতি। ঐ পাতার চর গ্রামেই রয়েছে তার নামে প্রতিষ্ঠিত “শহীদ আলতাফ মাহমুদ হাইস্কুল”
শহীদ আলতাফ মাহমুদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক বস্ত্রপ্রতিমন্ত্রী বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ সিরাজুল হক মন্টু। তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। কিন্তু মুলাদীর ঐ পাতারচর গ্রামে মিশে আছে তার জীবনের অনেক স্মৃতি। মুলাদী কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের পাশেই রয়েছে সাবেক বস্ত্রপ্রতিমন্ত্রী সিরাজুল হক মন্টুর কবর, পাশেই রয়েছে তার নামে প্রতিষ্ঠিত সিরাজুল হক মন্টু স্মৃতি সংসদ। ঐ স্মৃতি সংসদে গেলে তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে পারবেন। সেখানে সিরাজুল হক মন্টুকে নিয়ে লেখা অনেক বইপত্র ও তার স্মৃতি বিজরিত অনেক কিছু রয়েছে। সিরাজুল হক মন্টু স্মৃতি সংসদেও দায়িত্বে রয়েছে তারই সুযোগ্য ভাতিজা সাবেক ছাত্রনেতা অধ্যক্ষ আবিদুর রহমান হুমায়ুন। ঐ একই পরিবারের আরেক কৃতি পুরুষ আলহাজ্ব মোশারফ হোসেন মঙ্গু। তিনি বরিশাল-৩ (মুলাদী হিজলা) আসন থেকে ৪ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাতারচর গ্রামসহ মুলাদী উপজেলা সদওে মোশাররফ হোসেন মঙ্গুর বাড়ী রয়েছে। পর্যটকরা ইচ্ছা করলে সেই বাড়ীর আথিতেয়তা গ্রহন করতে পারেন। মুলাদী উপজেলা সদরে ঘুরে আপনি দেখতে পারবেন ঐতিহ্যবাহী মুলাদী ডিগ্রি কলেজ, মুলাদী ইসলামিয়া মাদ্রাসা, সু-সজ্জিত মুলাদী উপজেলা পরিষদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদ অডিটেরিয়াম, মুলাদী স্টেডিয়াম ও মামুন সিনেমা হল। স্টেডিয়ামের পাশেই রয়েছে মুলাদী পুলিশ ষ্টেশন। প্রয়োজনে আপনি সেখান থেকে পুলিশের সহযোগিতা নিতে পারেন।
মুলাদী পৌর এলাকা ঘুরে দেখার পর আপনি সেখান থেকে বাস, টেম্পু বা মোটর সাইকেলে চলে যেতে পারেন গাছুয়া গ্রামে। সেখানে গেলে দেখতে পারবেন ঐতিবাহি জমিদার বাড়ী। যা মিয়া বাড়ী নামে পরিচিত। সেখানে জমিদারদের পুরনো স্থাপনা সহ বিভিন্ন স্মৃতি রয়েছে। রয়েছে গাছুয়া আব্দুল কাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠা। ছোট্ট একটি খালের উপর পুল পেরুলেই হোসনাবাদ কলেজ। এই জায়গাটি মুলাদী-মৃধারহাট রাস্তার উপর। এখান থেকে সোজা চলে যেতে পারেন মৃধারহাট। এখানে রয়েছে পদ্মার শাখা নদী। ঐ পারেই শরীয়তপুর ও চাঁদপুরের মোহনা। আপনি এখান থেকে চলে যেতে পারেন চরকালেখান গ্রামে। সেখানে আপনি শুনতে পারবেন আলহাজ্ব জাম্মেদ আলী তালুকদারের জীবন ও কর্মের বিচিত্র্য কাহিনী। এই জামশেদ আলী তালুকদারের অক্লান্ত পরিশ্রমেই এখানে গড়ে উঠেছে চরকালেখান নেছারিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, চরকালেখান আদর্শ হাইস্কুল, চরকালেখান আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অসংখ্যা ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
পর্যটকরা ইচ্ছা করলে এখানে তালুকদার বাড়ীতেও আতিথেয়তা গ্রহণ করতে পারেন। চরকালেখান ইউনিয়ন ঘুরে আপনি চলে যেতে পারেন নাজিরপুর ইউনিয়নে। সেখানে গিয়ে আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, একটি চর অধুষ্যিত এলাকায় এই পরিবেশ সৃষ্টি হল কি করে। আপনি সেখানে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নাজিরপুর হাইস্কুল, দেখতে পারবেন এলাকায় উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নাজিরপুর ইউনাইটেড ডিগ্রী কলেজ। এখানে এসএসসি ও পিএসি পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।
আপনি নাজিরপুর ইউনিয়ন ঘুরে চলে যাবেন বাটামারা ইউনিয়নে। সেখানে রয়েছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুমার সম্প্রদায়। নিজ চোখে দেখতে পারবেন মাটি দিয়ে হাড়ি, পাতিল বানানোর দৃশ্য। এ ছাড়াও এখানকার সেলিমপুর গ্রামে দেখবেন ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প। সেখানে হস্তচালিত তাঁতের মেশিনে তৈরী হয় গামছা ও লুঙ্গী। এই সব এলাকা ঘুরে ফিরে আপনি চলে আসবেন সফিপুর ইউনিয়নে। সেখানে দেখতে পাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস মোল্লা বীর বিক্রম এর স্মৃতি বিজরিত জন্মস্থান। শুনতে পারবেন তার জীবনের আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনা। সেখানে আপনি প্রবীন সংবাদিক এস এ গফুর মোল্লা ও তার পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিতে পারেন।
যারা মুলাদীর বিভিন্ন ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে যাবেন, তারা যেতে পারেন উপজেলার কাজিরচর গ্রামে। সেখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী খাসেরহাট বন্দর। এখানে গেলে দেখতে পারবেন একই পরিবারের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩ জন শাহজাহান হাওলাদার, আমির হোসেন লালু পালোয়ান ও চুন্নু মোল্লার কবর। জানতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার কথা। আপনি সেখানে গেলে আলোকিত জমিদার সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদউদ্দিন মৃধার জীবন ও কর্ম-নিয়ে ইতিহাস শুনতে পারবেন দেখতে পারবেন তার রেখে যাওয়া স্মৃতি।
এরপর আপনি চলে যাবেন দক্ষিণ কাজিরচর গ্রামে। সেখানে গেলে দেখতে পারবেন বিশিষ্ট শিল্পপতি আরিফ মাহমুদের সু-সজ্জিত বাড়ী ও তার নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি স্যুটিং স্পষ্ট। পাশেই রয়েছে আরিফ মাহমুদ ডিগ্রী কলেজ সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে রয়েছে প্যাদারহাট বন্দর। যে বন্দরে সপ্তাহে চারদিন হাট বসে। মুলাদী-হিজলা ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে গেলে দেখতে পারবেন হিন্দু জমিদার, ঐতিহাসিক ধনুসিকদার বন্দর সহ অনেক দর্শনীয় স্থান।
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দরকার......
লেখায় যে সব স্থানের কথা উল্লেখ করলাম তাছাড়া মুলাদীতে প্রচুর ঐতিহ্যবাহী এলাকা ও নির্দশন রয়েছে। মুলাদী নদী বেষ্টিত উপজেলা হওয়াতে বড় সমস্যা হল, প্রতি বছরই কোন না কোন গ্রামবিলীন হয় নদী গর্ভে। আবার নতুন নতুন চর পড়ে। বর্তমানে মুলাদী উপজেলা অনেক অনাবাদী চর পড়ে রয়েছে। সরকার যদি ঐ সব এলাকা চিহ্নিত করে একটি পর্যটন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন তা হলে দেশ-বিদেশী পর্যটরা এখানে এসে স্বস্তিতে কিছু সময় কাটাতে পারবেন। মুলাদী উপজেলা ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে পারবেন। সাথে সাথে মুলাদী উপজেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গেও জীবনী, তাদের কর্ম এবং রেখে যাওয়া স্মৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে। নতুন প্রজন্মের কাছে মুলাদী হবে একটি আলোকিত স্থান।এ ব্যাপাওে সরকারের সাথে সাথে স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী ও আগ্রহী ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে আসতে পাবেন। মুলাদী পর্যটন কেন্দ্র হলে সেখান থেকে সরকার যেমন রাজস্ব পাবনে তেমনি উদ্যোক্তরা ব্যবসায়ীকাবে লাভবান হবেন।....
Tags
মুলাদীর কথন